প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধর্ষিত হচ্ছে নারী, ধর্ষণ কেন ঘটে ?
প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধর্ষিত হচ্ছে নারী, ধর্ষণ কেন ঘটে ?
 
 ধর্ষণ’ এখন একটি অতিপরিচিত শব্দ। 
প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধর্ষিত হচ্ছে নারী। এর বেশির ভাগই থেকে যায়
 অপ্রকাশিত। বিভিন্ন সেমিনার ও
গবেষণায় বলা হয়েছে, ধর্ষন ঘটনার খুব কমসংখ্যক খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রচার পায়। এর কারণ, এক. আক্রান্ত মেয়েটি জীবনের বাকি সময় 
সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য মুখ খুলতে
 নারাজ। দুই. প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সামর্থ্য নেই তার। তিন. অধিকাংশ 
ক্ষেত্রে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত পুরুষটি 
থাকে সমাজের প্রভাবশালীদের কেউ। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কায় নীরব থাকার চেষ্টা করে আক্রান্ত নারী।
 আমরা সবাই নারীদের অধিকার চাই। বাংলাদেশে নারী অধিকার আদায়ে মাঠে রয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। নারীরা বিভিন্ন সময় তাদের অধিকার রক্ষার 
জন্য রাজপথ উত্তালও করে। বিভিন্ন দাবি 
নিয়ে রাস্তায় সভা-সমাবেশ-মানববন্ধন করে বক্তৃতাও হচ্ছে। কিন্তু এত সবের 
পরও নারীর প্রতি নির্যাতন 
কমছে কই। এখনো প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে 
নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে; ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে উত্ত্যক্ত 
হচ্ছে নারী। বাসের সহকারীর কাছ থেকে 
অসৌজন্যমূলক আচরণ পাচ্ছে। রাস্তা থেকে 
নারীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। ধর্ষিতা নারীর বস্ত্রহীন লাশ পড়ে 
থাকে পথে-জলা-জঙ্গলে। কখনো 
অপহৃতা নারীর খোঁজই পাওয়া যায় না।
 প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে এত এত শক্তিশালী নারী সংগঠন মাঠে সক্রিয় থাকার পরও কেন নারীর প্রতি নির্যাতন ও ধর্ষণ কমছে না?
 আমাদের সমাজব্যবস্থা নারীদের নিয়ে কী ভাবছে? কোন পথে ধাবিত করা হচ্ছে নারীকে? যাদের মধ্যে ধর্ম-কর্ম ছিল না, একসময় তারাই নারী 
নির্যাতন করত। কিন্তু ধর্মগুরু আশারাম 
বাপুরা যখন নারীকে যৌন হয়রানির দায়ে গ্রেফতার হচ্ছেন, তখন আমরা কাকে 
দোষারূপ করব? সাম্প্রতিককালে 
ভারতে যৌন হয়রানির দায়ে একাধিক ধর্মগুরুকে গ্রেফতার হতে দেখা গেছে। আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্যা ‘পরিমল’, যাদের হয়তো আমরা এখনো 
চিনতে পারি না। ২০১০ সালের শুরুর দিকে 
দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শেষের পাতায় প্রধান সংবাদ ছিল ‘লজ্জায় 
ইডেন ছাড়ছেন ছাত্রীরা’। 
ওই সময় বিভিন্ন সংবাদপত্র ইডেন কলেজের 
নেত্রীদের নারী কেলেঙ্কারি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করেছিল। ওই সব 
রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা জানতে 
পেরেছি, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও নাকি কারো কারো নারী আসক্তি দূর হয়নি। তাহলে আমার কোথায় নিরাপদ?
 অতিসম্প্রতি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের কোরাইশমুন্সীতে মা-মেয়েকে গণধর্ষণ করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। ওই ধর্ষণের 
ঘটনায় মেয়েটি এখনো নিখোঁজ। ধর্ষণকারী 
একজনকে আসামি না করে উল্টো সাক্ষী করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি এ 
ঘটনার বিচার পাবে কি না 
জানি না, তবে এ কথা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়, প্রকৃত আসামিদের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।
 ১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানতে 
পেলাম, ভারতে আবারও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ বছর বয়সী এক ছাত্রী 
ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাকে 
উপর্যুপরি ধর্ষণ করে মোবাইল ফোনে ওই সব 
দৃশ্য ধারণ করে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছে ধর্ষকরা। ওই ছাত্রীর 
কাছ থেকে আর্থিক সুবিধাও 
নিয়েছে অভিযুক্ত যুবক।
 এক খবরে প্রকাশ, প্রতিবেশী দেশটিতে প্রতি 
২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এবার ধর্ষণে অতীতের সব রেকর্ড 
ভঙ্গ করেছে সে দেশের 
ধর্ষকরা। ২০১৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত 
ধর্ষণের মামলা হয়েছে এক হাজার ১২১টি। ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর 
(এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ 
সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৪৬৮টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১১ সালে ৫৭২টি এবং ২০১০ সালে ৫০৭টি মামলা করা হয়।
 বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় আঁতকে ওঠার মতো 
পরিসংখ্যানটি দিয়েছে সাউথ এশিয়ান লইয়ার্স ফোরাম। তাদের দেয়া তথ্যমতে, 
২০১২ সালে বাংলাদেশে
 ৭৭১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। 
ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১০৬ নারীকে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫৭ জন! এ
 চিত্রটি কেবলই বিভিন্ন 
আদালতে মামলা অথবা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে
 প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের প্রকৃত 
পরিসংখ্যান এর কয়েক গুণ বেশি হতে পারে।
 বিদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সমাজের 
সব শ্রেণী-পেশার মানুষ একাত্ম হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ধর্ষণকাণ্ডে 
ভারতজুড়ে প্রতিবাদ হতে দেখেছি 
আমরা। ভারতীয় সরকার বাধ্য হয়েছে 
ধর্ষকদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ষণ 
ঘটনায় যথেষ্ট প্রতিবাদ হতে দেখা
 যায় না। সরকারি তরফে তেমন 
দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী,
 বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার ও সংসদ 
উপনেতা নারী। একাধিক নারী মন্ত্রীও রয়েছেন। রয়েছেন একাধিক নারী বিচারপতি।
 গত বছরের জুলাই মাসে ধর্ষণের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন। তাদের দেয়া তথ্যমতে, ওই মাসে ধর্ষণের পর ১৬ 
নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের বলি হয়েছে ৩৮ নারী। পাঁচজন গৃহপরিচারিকা আর ইভ টিজিংয়ে কারণে তিন নারীকে জীবন দিতে হয়েছে। 
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই মাসে ৭৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়। এদের মধ্যে নারী ২৬ ও শিশু ৫১ জন। ইভ টিজিংয়ের শিকার হয় ২৩ জন নারী।
 শিশু, কিশোরী, যুবতী, বৃদ্ধা, স্কুলছাত্রী,
 পোশাককর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমনকি ভিখারিনীও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণের 
কবল থেকে। এই বেপরোয়া 
ধর্ষকদের প্রতিরোধের যেন কেউ নেই। 
সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক 
প্রভাব, পর্নো ছবির সহজপ্রাপ্যতা
, সর্বোপরি নারীর প্রতি সহিংসতার প্রবণতায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা।
 এখন প্রশ্ন হলো, এমন বেপরোয়া ধর্ষণকাণ্ড 
কেন হয়? ধর্ষকরা কারা? কী তাদের পরিচয়? যারা ধর্ষিতা হচ্ছে, তারা কারা? 
ধর্ষণের প্রকৃত কারণ কী? 
এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া খুব সহজ কাজ 
নয়। আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে দেখি, কিছু সংবাদমাধ্যম নারী 
ধর্ষণের ঘটনা বড় শিরোনামে 
প্রকাশ করে। ধর্ষিতার ছবিও মাঝেমধ্যে 
প্রকাশ পায়। কিন্তু ধর্ষণের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে কেউ ভাবে না। প্রকৃত 
দোষী ব্যক্তির শাস্তির দাবিও জোরালো হয় না।
 নারী ধর্ষণের পেছনে আমি দুটি গুরুত্বপূর্ণ 
কারণ উল্লেখ করতে চাই। এক. সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুসরণ না করা। দুই.
 নারীর নিজেকে চক্ষুশোভা করে ঘরের বাইরে আসা।
 একটু বিস্তারিতভাবে বললে, পৃথিবীর সব ধর্মই
 নারীকে সম্মান করতে শেখায়। কোনো ধর্মগ্রন্থই নারীদেহ সব মানুষের কাছে 
দৃষ্টিনন্দন করে উপস্থাপন 
করতে বলেনি। সব ধর্মেই নারীকে সংযত পোশাক পরতে বলা হয়েছে। সামাজিক দিক থেকে বললে, কোনো যুবতীকে দেখে তাকে ভোগ করার কামনা 
করাটা যেমন বখাটেপনা, তেমনি কোনো নারীর 
অসংযত পোশাক পরে রাস্তায় বের হওয়াটাও নির্লজ্জতা। এই দুটি ক্ষেত্রেই 
আমাদের বড় ধরনের ব্যত্যয় হচ্ছে।
 আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও রয়ে গেছে গলদ। 
সেখানে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে তেমন জোর দেয়া হয়নি। একসময় 
স্কুল-কলেজে সপ্তাহে এক দিন ধর্ম ও 
নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হতো। আর এখন ধর্মচর্চা করা হলে তাকে উগ্রপন্থী অথবা মৌলবাদী বলে সন্দেহ করা হয়। এখন পবিত্র কোরআন, গীতা, বেদ, 
বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের ধারা কমে গেছে; ফলে কমছে মূল্যবোধ। এরই অমোঘ পরিণতি সমাজের নানা অঘটন।
 অনেকে আইনের শাসনের কথাও বলেন। তাদের মতে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে নারী আর ধর্ষণের শিকার হবে না। নিজের অধিকার ফিরে পাবে 
প্রত্যেক নারী। কিন্তু আইনের শাসন 
প্রতিষ্ঠার জন্যও দরকার নৈতিকতা। নৈতিক মানসম্পন্ন একদল দক্ষ নেতৃত্ব 
রাষ্ট্র পরিচালনায় না থাকলে একটি সুন্দর 
সমাজ দেখার ইচ্ছা স্বপ্নই থেকে যাবে।  
 
 
 
 
          
      
 
  
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
No comments:
Post a Comment